যে তরুণরা বাংলাদেশের শত শত বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দিয়েছে

সারা বিশ্বে মিলিয়ন মিলিয়ন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়, আর কভিড ১৯ প্রাদুর্ভাব সেই সমস্যাকে আরো তীব্র করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যারা এই ব্যবস্থা বন্ধ করেছে তাদের নিয়ে এসবিএস বাংলার প্রতিবেদন।

Dola Akter Reba

Dola Akter Reba's mum was married when she was 13. Source: World Vision

যখন দোলা আক্তার রেবা মাত্র ১২ বছরের কিশোরী, তখন তার প্রতিবেশী 'ঘটকরা' তার মাকে এসে বললো এই মেয়েটির ভালো বিয়ে দেয়া যাবে। 

বাংলাদেশ থেকে সে এসবিএস নিউজকে বলে, "আমার কয়েকজন প্রতিবেশী এসে আমার মাকে বলে 'তোমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও, আমাদের কাছে ভালো পাত্র আছে', এমন কিছু।" 

তার নিজের মায়ের মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার চেয়ে আট বছরের বড় ব্যক্তির সাথে।  

দোলা বলে, "আমি যখন আমার মায়ের ছোটবেলার কথা জানতে চাই তখন তিনি তা বলতে পারেননি কারণ তাকে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে একটা পরিবার সামাল দিতে হতো।"

বাংলাদেশের শিশু অধিকার কর্মীরা বলেন, বাল্যবিবাহের হার পৃথিবীর যে দেশগুলোতে সবোর্চ্চ তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, এখানে অর্ধেকেরও বেশি মেয়েদের বিয়ে হয় ১৮ পেরোনোর আগেই, এবং ১৮ ভাগের বিয়ে হয় ১৫ বছর হবার আগে। 

মানবিক সাহায্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বলেছে অল্প বয়সে বিয়ে হলে একটি মেয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে, তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, এবং হয়তো জীবনভর দারিদ্রের মধ্যে থাকতে হয়।  

মায়ের হারানো বাল্যকালের কথা মনে রেখে ১৬ বছরের দোলাসহ আরো অনেক তরুণ অধিকার কর্মীরা এখন কাজ করছেন শিশুদের অধিকার নিয়ে, তারা বাবামায়েদের বোঝাচ্ছেন তাদের মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দিলে কি ক্ষতি হয়। 

দোলা ওয়ার্ল্ড ভিশনে যোগ দিয়ে সেখানে কিছু ট্রেইনিং নিয়েছে, সে প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের একটি দলের অংশ হিসেবে শিশুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরীর কাজ করছে। 

সে ও তার সহকর্মীরা গত দুবছরে ৬ শতেরও বেশি বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পেরেছে। 

এই চ্যারিটি সংস্থা তাদের গৃহীত দান দিয়ে আফ্রিকা ও নেপালসহ সারা বিশ্বের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের সাহায্য করে থাকে। সংস্থাটি বলছে তারা বাল্যবিবাহ বন্ধে বাংলাদেশে বিভিন্ন কমিউনিটির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে, বিভিন্ন ক্লাব ও শিশু ফোরামের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে সরাসরি যুক্ত করছে, তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং অভিভাবকদের বুঝিয়ে এই সমস্যার অবসানে কাজ করছে। 

 

Border Districts in Bangladesh are Grappling with COVID 19 Surge (File image).
Border Districts in Bangladesh are Grappling with COVID 19 Surge (File image). Source: NurPhoto/Getty Images
ওয়ার্ল্ড ভিশন অস্ট্রেলিয়ার সিনিয়র পলিসি এডভাইজার মার্সি জুমো বলেন, "যখন তরুণরা এ ধরণের ক্লাবে কাজ করে, কমিউনিটিতে কি ঘটছে তার একটা চিত্র তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়।"

"এটা অনেকটা পূর্ব সতর্কতার মত কিছু যার মাধ্যমে বোঝা যায় কতজন স্কুলে যাচ্ছে এবং এতে স্কুলগুলোও উপকৃত হচ্ছে - তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন ধর্মীয় নেতাদের সাথেও এ বিষয়ে কথা বলেছে - তারা এই ব্যবস্থায় ধারণা করতে পারে হয়তো ওই বাচ্চাদের জীবনে কিছু একটা ঘটছে। অথবা তারা কেন স্কুলে যাচ্ছে না তাদের বাড়ী গিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে।"

দোলা ১০ বছর বয়স থেকেই ওয়ার্ল্ড ভিশন চাইল্ড ফোরামের কর্মী এবং সে এখন লিডারশিপ টিমের অংশ। গত বছর সে জেনেভায় জাতিসংঙ্ঘে তার দেশের মেয়েদের পক্ষে বক্তব্য রাখে এবং তার কাজের সাফল্যের কথা জানায়।  

দোলা বলে,"চাইল্ড ফোরাম বাল্যবিবাহ বন্ধে পরিশ্রম করছে এবং আমরা সাফল্য পাচ্ছি, কিন্তু আমাদের মেয়েদের এর থেকে রক্ষা করতে আরো কিছু করতে হবে।" 

"আমরা অল্পবয়সী হয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধে যুক্ত হচ্ছি কারণ তাদের দুঃখ এবং কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলো আমরা বুঝি। যখন ১৮ বছর বয়সের নীচে কোন মেয়ের বিয়ে হয়, তখন সে মা ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে, তাদের পড়াশোনা হয় না, বাড়ীতে সহিংসতা এবং নিপীড়ণের শিকার হয়।"
Dola in Geneva
Dola 16, is working to protect other girls in Bangladesh. Source: World Vision
বাল্যবিবাহ বন্ধে হিলাল* নামে ১৯ বছরের আরো এক তরুণ কাজ করছে। তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় থাকে এবং তার ১২ বছর বয়স থেকেই সামনে থেকে কাজ করছে। তিনি বলছিলেন তার ১৫ বছরের বোনকে যখন বিয়ে দেয়া হয় এবং অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে, সেই দুঃখজনক ঘটনা তাকে ভাবায়।  

তিনি বলেন, "এর দুবছর পরেই তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দেয়। সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেইসাথে তার বাচ্চাটিও। সে তখনও একটা অল্পবয়সী মেয়ে, কিভাবে একজন ভাবে সে আরেকটা বাচ্চাকে পালন করবে?"

হিলাল ১৯টি বাল্যবিবাহ বন্ধে সরাসরি ভূমিকা রাখে, অনেকটা নাটকীয়ভাবে। এই কাজটি তার জন্য সহজ ছিল না, তাকে পুলিশের সাহায্য নিতে হয়েছে, অনেক সময় বিপজ্জনক অবস্থায় সে পড়েছে, এমনকি তার পরিবারের মধ্যে থেকেও। 

"আমি একবার আমার জ্ঞাতি বোনের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হই, আমার মনে হলো তার বয়স ১৫, কিন্তু সে বললো ১৮, আমার বিশ্বাস হলো না। আমি তার জন্মসনদ চাইলাম সে দেখতে পারলো না।"  

সে পুরো ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জ করলে তার পরিবার তাকে হুমকি দিলো, তার জ্ঞাতি ভাইয়েরা তাকে বাশ দিয়ে পেটালো। কিন্তু তাতে সে দমে যায়নি, একজন জেলা কর্মকর্তার সাহায্যে সে বিয়েটি বন্ধ করতে পেরেছিলো। 

বাল্যবিবাহ শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা নয়। ইউনাইটেড নেশনস ফ্যামিলি প্ল্যানিং এসোসিয়েশনের মতে, সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১৮ বছরের নীচে ২৩ জন করে বালিকাকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং আগামী এক দশকে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১৩ মিলিয়ন, এর কারণ কভিড ১৯-জনিত অর্থনৈতিক মন্দা।
Dola speaking at the UN in Geneva.
Dola speaking at the UN in Geneva. Source: World Vision
কোন কোন দারিদ্রপীড়িত এলাকায় পরিস্থিতি আগের চেয়ে এতই করুন যে, তারা তাদের ১০ বছর বয়সী মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে মরিয়া। 

মিজ জুমো বলেন, "কভিড ১৯ বেড়ে চলেছে এবং সেই সাথে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, কারণ সমস্যাগুলো একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত, তার মধ্যে অন্যতম কভিড ১৯-জনিত অর্থনৈতিক সংকট।"

"অনেকের জীবিকা শেষ হয়ে গেছে, মানুষেরা কাজকর্মহীন, পরিবারের খরচ যোগাতে পারছে না। অনেকে দেশে লকডাউনে থাকা নাগরিকদের জন্য সরকারের কোন সহায়তা নেই। সুতরাং কিছু পরিবার মনে করছে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়াই একমাত্র উপায়।" 

"এখানে সমাজে মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে কিছু রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিও আছে, অনেকে মনে করেন মেয়েদের পড়াশোনা করানো অর্থের অপচয়, এর চেয়ে বরং ছেলেদের জন্য বিনিয়োগ করা ভালো কারণ মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে এবং তারা অন্য পরিবারের জন্য কাজ করবে, তাই এটা অপচয়।"
Countries with the highest rates of child marriage.
Countries with the highest rates of child marriage. Source: World Vision
*ছদ্মনাম 

আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ পারিবারিক সহিংসতার শিকার হলে ফোন করুন 1800RESPECT অথবা 1800 737 732 অথবা ভিজিট করুন:  অথবা জরুরী প্রয়োজনে কল করুন 000 

আরো পড়ুনঃ



Share
Published 25 September 2020 12:49pm
Updated 25 September 2020 1:01pm
By Essam Al-Ghalib
Presented by Shahan Alam


Share this with family and friends