মাছ ধরতে গিয়ে সিডনীতে দুজন বাংলাদেশির মৃত্যুতে শোকাহত কমিউনিটি, সতর্ক হওয়ার পরামর্শ

সিডনীর অদূরে পোর্ট কেম্বলার হিল সিক্সটি নামক একটি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় রক ফিশিংয়ে গিয়ে মাহাদী খান ও মুজাফ্ফর আহাম্মেদ নাম দুজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মারা যান।

Mozaffar Ahmed and Mahdi Khan

Mozaffar Ahmed and Mahdi Khan Source: S M Aminul Wrubel/Facebook

গত একমাসে একই ভাবে আরও দুটি পৃথক দুর্ঘটনায় আরও তিনজন মারা গেছে। তারা ছিলেন পেশাদার ফিশারম্যান। তবে ৩১ বছর বয়স্ক মাহাদি খান এবং ৩৮ বছরের মোজাফ্ফর আহমেদ শখের বশে মাছ ধরতেন। 

গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায় ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় সিডনীর বাংলাদেশি কমিউনিটি শোকাচ্ছন্ন। এসবিএস বাংলাকে তারা জানিয়েছেন তাদের প্রতিক্রিয়া 

মাহ্দী খান ও মোজাফ্ফর আহাম্মেদ ছিলেন সিডনির ল্যাকেম্বা এলাকার পরিচিত মুখ

দুজনকেই ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন গণমাধ্যম কর্মী এসএম আমিনুল রুবেল। তিনি বলেন, তারা ছিলেন সিডনির ল্যাকেম্বা এলাকার পরিচিত মুখ। 

এস এম আমিনুল রুবেল বলেন, "লাকেম্বাতে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন, তাই চেহেরায় হলেও অনেকেই তাদের চিনতেন। আর এজন্যই কমিউনিটিতে শোকের আবহটা বেশি।”
S M Aminul Wrubel
S M Aminul Wrubel Source: S M Aminul Wrubel
তিনি বলেন, “অনেকেই ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উপলক্ষে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডেকোরেশন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এমন একটি ঘটনায় সেটি তারা বাতিল করে দেয়; বিষয়টি কমিউনিটিতে এতটাই প্রভাব ফেলেছে।” 

তিনি এসবিএস বাংলাকে জানান,  “মাহ্দী খান ও মোজাফ্ফর আহাম্মেদকে পানি থেকে বাঁচাতে তৎক্ষণাৎ উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরে উলঙ্গগং পুলিশের একজন সাহসী কর্মী। কিন্তু মাহ্দী খানকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, অন্যদিকে মোজাফ্ফর আহাম্মেদ মারা যান হসপিটালে।”

তিনি বলেন, “মৃত উদ্ধারের পর দেখা যায়, তাদের মাথায় আঘাত ছিল, ধারনা করা হচ্ছে প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে যাওয়া ওই দুজন পাথরে আঘাত পান। তাদের সাথে আরও একজন ছিলেন, তিনি পাথর আঁকড়ে থাকতে সমর্থ হন এবং বেঁচে যান।”

মিঃ রুবেল জানান, মাহাদী ল্যাকাম্বার ‘মাহি হালাল বুচারি’ ও ‘ঘরোয়া কিচেন’-এর ব্যবসায়ী ও সৌখিন মাছ শিকারী। মাহাদী খান সম্প্রতি বিয়ে করেছিলেন, তার স্ত্রী বাংলাদেশে আছেন।

এই ঘটনায় নিহত আরেকজন মোজাফ্ফর আহাম্মেদের কর্মক্ষেত্র ছিল ল্যাকেম্বার ‘ডেইলী শপিং’ নামে একটি দোকান, তিনি ছিলেন ওয়ালী পার্কের বাসিন্দা।

সিডনীর বাসিন্দা মিঃ এইচ এম লাবু মাহ্দী খান সম্পর্কে বলেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক একজন মানুষ, বেশ কয়েক বছর ধরেই তাকে তিনি চেনেন, তার বাবাকেও ভালো করে চেনেন তিনি।
H M Labu
H M Labu Source: H M Labu
তিনি বলেন, এখানে তার বাবার একটি রেস্টুরেন্ট এবং বুচার শপ আছে, তারা এ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন। 

"তারা অনেকেই ওই এলাকায় প্রায়ই মাছ ধরতে যেতেন, ওটা ছিল তাদের শখ।" 

সিডনির মঈদুল ইসলাম জনি বলেন, ওই দুজন কমিউনিটিতে বেশ পরিচিত ছিলেন, তারা সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন বলে সুনাম আছে। 

তিনি বলেন, "এই ঘটনায় আমরা সবাই শোকাহত। আমরা সবাই একসাথে নামাজ পড়তাম, একসাথে ঘুরতাম, চলাফেরা করতাম, সবাই সবাইকে সাহায্য করতাম। তাদের মৃত্যু আসলেই আমাদের মধ্যে খুব প্রভাব ফেলেছে।"
Moidul Islam Jony
Moidul Islam Jony Source: Moidul Islam Jony
একই এলাকার ওয়াসিমুজ্জামান রুবেল এই ঘটনায় নিহত মাহ্দী খান ও মোজাফ্ফর আহাম্মেদকে চিনতেন না, তবে তার পরিচিত অনেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেন, অনেকেই এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন, প্রত্যেকটি সময়ে তারা উদ্বেগের সাথে খবর নিয়েছেন এই ঘটনার।

সিডনির মুরসালীন আলী জানান, লাকেম্বাতে গেলে প্রায়ই তাদের দেখেছেন, তারা ছিলেন পরিচিত মুখ।  

তিনি বলেন, "এমন দুটি আকস্মিক মৃত্যু, কমিউনিটিতে প্রচন্ড প্রভাব ফেলেছে। এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু, একজনকে যাকে আমি ভালো করে চিনতাম তার বয়স ছিলো মাত্র ৩০, তিনি বাংলাদেশ থেকে মাত্র বিয়ে করে এসেছেন। খুবই দুঃখজনক, তিনি ছিলেন বাবামায়ের একমাত্র ছেলে।”
Mursalin Ali
Mursalin Ali Source: Mursalin Ali
 

সিডনীর চিকিৎসক ডঃ চৌধুরী বেগ বলেন, তার দুয়েকবার মাহাদির সাথে দেখা হয়েছিল। যেহেতু তারা বাঙালি অধ্যুষিত লাকেম্বার ব্যবসায়ী তাই তারা ছিলেন সবাই কমিউনিটিতে চেনাজানা। 

তবে তিনি বলেন, ফেইসবুক এবং কমিউনিটি সূত্রে তিনি জেনেছেন তারা ছিলেন হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল, এবং উৎসাহী। তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং কমিউনিটিতে ছিলেন খুবই সক্রিয়। 

ডঃ বেগ বলেন, এমন দুজন ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে কমুউনিটির সবাই স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত শোকার্ত। 

মাছ শিকারে যাওয়ার আগে প্রয়োজন সতর্কতা, বিশেষ করে 'রক ফিশিংয়ে'

পোর্ট কেম্বলার হিল ৬০ নামক একই স্থানে বার বার দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন মাছ ধরতে যাওয়া ব্যক্তিরা। এর আগেও গত একমাসের মধ্যে কয়েকজন পেশাদার জেলে দুটি পৃথক ঘটনায় একইভাবে নিহত হয়। স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠেছে ওই এলাকায় মাছ শিকার কতটা নিরাপদ তা নিয়ে। 

সিডনীর চিকিৎসক ডঃ চৌধুরী বেগ বলেন, মাছ শিকারে যাওয়া অনেকেই নিরাপত্তা বিষয়ে উদাসীন।
Dr Chowdhury Beg
Dr Chowdhury Beg Source: Dr Chowdhury Beg
যারা মাছ শিকারে যাচ্ছেন তাদের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, "তারা যাতে প্রোপার গাইডেন্স, এডুকেশন এবং প্রটেকশন নিয়ে যান।"

তবে এরপরেও তিনি বলেন, অনেকেই তো নিরাপদ থাকতে চান, হয়তো সময়টা তাদের অনুকূলে ছিল না। 

"খুবই দুৰ্ভাগ্যজনক, তারপরেও বলবো এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সবাইকে সতর্ক হতে হবে।" 

তিনি বলেন, দুর্ঘটনার জায়গাটি মাছ শিকারের জন্য খুবই জনপ্রিয় জায়গা। কিন্তু অনেক পেশাদার মাছশিকারীরা যথেষ্ট প্রটেকশন এবং লজিস্টিকস ব্যবহার করেও বিপদে পড়েছেন। 

"সেই প্রেক্ষিতে বলবো যারা সৌখিন মাছ শিকারী তাদের তো আরো সতর্ক হতে হবে।"

তিনি ঘটনার সময়ে ইলাওয়ারা পুলিশ বিভাগের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, "একজন পুলিশ সদস্য তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেন।" 

এতো দুর্ঘটনার পরেও মানুষ ঠিক একই জায়গায় যাচ্ছেন এ প্রসঙ্গে এস এম আমিনুল রুবেল বলেন, "বাস্তবতা হচ্ছে, যতদূর জানা যায় যেখানে ওয়েভ বেশি উঠে সেখানেই মাছ বেশি পাওয়া যায়। আর মাহাদী খান মৎসশিকারী হিসেবে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিলেন, তবে তিনি শখের বশেই তিনি এটা করতেন। এমন হয়েছে যে তিনি গাড়ি ভরে মাছ নিয়ে আসতেন, সেগুলো লাকেম্বার সবাইকে দিয়ে আসতেন বা বারবিকিউ করতেন সবার জন্য।"

"তিনি ছোটবেলা থেকেই সৌখিন মাছ শিকারী, তিনি ওই জায়গাতে শত শত বার গেছেন, তাই তার অনেক আত্মবিশ্বাস ছিল। সেখানে প্রটেকশনের ব্যবস্থা ছিল, সাথে সাথে পুলিশ ঝাঁপ দিয়েছে তাদের বাঁচাতে, কিছুক্ষনের মধ্যেই হেলিকপ্টার এসেছে।"

"কিন্তু দুৰ্ভাগ্যবশতঃ ওয়েভ অনেক বেশি ছিল, যার কারণে তারা ভেসে গিয়েছেন।”

সিডনির বাসিন্দা ওয়াসিমুজ্জামান রুবেল তার মাছ শিকারের অভিজ্ঞতা থেকে এই দুর্ঘটনা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, "সাধরণত যেখানে বড় বড় ঢেউ হয়, সেই জায়গাতে মাছ পাওয়া যায় বেশি, এবং এটিকেই রক ফিশিং বলে। কিন্তু এসব স্থানে নিরাপত্তা সম্পর্কে খুবই সচেতন হতে হয়। যতদূর জানি এবং পুলিশ সূত্রে জানা যায় যে তাদের পড়নে কোন লাইফ জ্যাকেট ছিল না, এটা খুবই অপরিহার্য্য ব্যবস্থা যে মাছ ধরতে গেলে লাইফ জ্যাকেট পড়তে হবে।"
Wasimuzzaman Rubel
Wasimuzzaman Rubel Source: Wasimuzzaman Rubel
তিনি বলেন, "রক ফিশিংয়ের লাইসেন্সের একটি শর্ত হচ্ছে সাথে লাইফ জ্যাকেট থাকতে হবে, এবং পড়তে হবে।'

রক ফিশিং কি?

মিঃ ওয়াসিমুজ্জামান রুবেল বলেন, "রক ফিশিং হচ্ছে পাহাড়ের পাড়ে যেখানে অনেক পাথুরে জায়গা আছে, যেখানে সাধারণত বালি থাকে না, সেখানে রক বা বড় বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে মাছ ধরে সবাই। সেখানে মাছ পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি, ওই জায়গাগুলো মাছ ধরার পপুলার স্পট। কিন্তু সেখানে অনেক ঢেউ থাকে, যা নিরাপত্তার জন্য একটি ঝুঁকি।"

মিঃ রুবেল বলেন, মাছ ধরতে গেলে বিশেষ করে রক ফিশিংয়ের জন্য অনেক কিছু লক্ষ্য রাখতে হয়। সেখানকার আবহাওয়ার পরিস্থিতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো করে দেখা উচিত, বিশেষ করে যারা রিক্রিয়েশনাল ফিশিং করে তাদের আরো সতর্ক হতে হবে। 

মিঃ মুরসালীন আলী বলেন, অনেক সময় সেফটি বিষয়ে নানা সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি থাকলেও মানুষ অনেক সময় এসব বিষয়ে উদাসীন থাকে, এক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। 

মিঃ মঈদুল ইসলাম জনি বলেন, ওই জায়গাগুলোতে যাতে আরো সতর্কীকরণ ব্যবস্থা নেয়া হয়, এজন্য কমিউনিটি থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার কথা অনেকেই বলছেন। 

এদিকে নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ডিন স্মিথ বলেন, তারা ধারণা করছেন ওই ব্যক্তিরা লাইফ জ্যাকেট পড়েননি।   

তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা দেখেছি এখানে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে। আমারা সার্ফ লাইফ সেইভিং, ওয়াটার পুলিশ এবং স্থানীয় কাউন্সিলের সাথে কাজ করছি যাতে সবাইকে সতর্কবার্তাগুলো ক্রমাগত জানানো যায়। 

আরও দেখুনঃ


 

  


Share
Published 14 February 2021 6:50pm
Updated 14 February 2021 7:38pm
By Shahan Alam
Presented by Shahan Alam


Share this with family and friends