ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজায় রাজনীতিচর্চা এবং নস্টালজিয়া

আজ মঙ্গলবার ১ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আসছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। পুজো-মণ্ডপ উদ্বোধন করার কথা আছে তাঁর।এর মধ্যে, মহালয়ার ঠিক আগের দিন বিজেপির নাম না করে ধর্ম-রাজনীতিকে নিশানা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

An artisan paints clay idol of Hindu goddess Durga at a makeshift studio in Kolkata, India, Wednesday, Sept. 25, 2019. The idols are being made for worship venues ahead of Durga Puja festival that begins first week of October. (AP Photo/Bikas Das)

An artisan paints clay idol of Hindu goddess Durga at a makeshift studio in Kolkata, India, Wednesday, Sept. 25, 2019. Source: AP Photo/Bikas Das

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজোয় বাধা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের প্রচারে রাজ্যে এসে প্রতিটি সভায় নিয়ম করে বলে গিয়েছেন বিজেপির অমিত শাহ থেকে নরেন্দ্র মোদী।পুজো উদ্বোধনে গিয়ে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রসঙ্গ না তুলেই জবাব দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন,ধর্ম নিয়ে প্রচার করেন না, মাকে যে ভালবাসে সে বাইরে গিয়ে বলে না। আজ, মঙ্গলবার ১ অক্টোবর রাজ্যে আসছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। পুজো মণ্ডপ উদ্বোধন করার কথা আছে তাঁর।

এর মধ্যে, মহালয়ার ঠিক আগের দিন বিজেপির নাম না করে ধর্ম-রাজনীতিকে নিশানা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার সংস্কৃতি যে ভিন্ন, তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। আর তাঁর দুর্গাভক্তি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তারও জবাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, পুজোর সময় রাজনীতি করেন না। যাঁরা কুৎসা, অপপ্রচার দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁদের পছন্দ নয়। মায়ের মুখ দেখে একটু হাসতে ইচ্ছে করে না, সবাই যাতে মাকে ভালবাসে সেটা ইচ্ছে করে না। বলেছেন, ধর্ম নিয়ে প্রচার করেন না। মাকে যে ভালবাসে, সে বাইরে গিয়ে বলে না। বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় না। সীতার অগ্নিপরীক্ষা বারবার হয় না। পুজোর দিনগুলিতে রাজনীতিবর্জিত সুস্থ সংস্কৃতি মেনে চলা উচিত বলে মনে করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Mamata Banerjee
Mamata Banerjee. Source: Getty Images
আসলে, গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা তথা বাংলার পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন রাজনীতির নেতা -নেত্রীরা। কলকাতার দক্ষিণ থেকে উত্তর, প্রায় সব বিখ্যাত পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মেয়র ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী, এরূপ বিশ্বাস, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সুজিত বসু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও। বামপন্থীরা পুজোতে তেমনভাবে না জড়ালেও পুজো মণ্ডপে দলীয় মতাদর্শের পুস্তিকা প্রচারের জন্যে ষ্টল দেন। এবার সেখানে প্রবলভাবে উঠে আসছে বিজেপি। যার রেশ ধরেই, এবার খোদ বিজেপি সভাপতি কলকাতার পুজো উদবোধনে, এই প্রথমবার। এই অবস্থায়, মহালয়ার আগের দিন থেকে পুজো উদ্বোধন শুরু করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই আবহে, অস্ত্রধারী পুলিশ এবং সিসিটিভি ক্যামেরার কড়া নিরাপত্তার আঁটোসাঁটো বলয়ে উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায় তৈরি হচ্ছে দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গনেশ। ষোলো টনের শ্বেত পাথর এবং অন্য জায়গায় ১১০ কেজি ওজনের রুপোর অলঙ্কারে সাজছেন স্বপরিবার উমা। কলকাতার কামারডাঙা সাধারণ দুর্গোৎসব সমিতি এবছর শতবর্ষে পদার্পণ করল। শতবর্ষে এবারের দুর্গা, একশোতে একশো দশ রুপোর প্রতিমা। অর্থাৎ ১১০ কেজি রুপো দিয়ে তৈরি হচ্ছে শতবর্ষের মাতৃ-প্রতিমা। প্রতিমার আদল শান্তিরূপী মৃন্ময়ী, যেখানে অসুরকে বিনাশ করে শান্তির বার্তা নিয়ে মা নিজেই দাঁড়িয়ে থাকবেন অসুরের শরীরের ওপর।

পশ্চিমবঙ্গে তথা দু’ পাড় বাংলায় দুর্গাপুজোকে সার্বজনীন উৎসব বলা হয়। অর্থাৎ এই পুজো সকলের জন্য। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই পুজোকে সকলেই নিজের পুজো মনে করে। ছোটবেলায় গ্রামের পুজোর কথা অনেকের স্মৃতিতে প্রখর।সম্পন্ন গ্রাম, গ্রামে মুসলিম পরিবারও থাকেন, পুজোয় সব ধর্মের মানুষই সমান উপভোগ করেন।

পুজো এখন বিখ্যাত হয় থিমের জন্যে। এই যেমন মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান জল ধরো জল ভরো, অর্থাৎ বৃষ্টির জলকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ।বহু বহু বছর আগে গুজরাতের এক রানি জল সংরক্ষণ করতে কোমর কষে নেমেছিলেন।

আহিরিটোলা সার্বজনীন সমিতির মণ্ডপে সেই প্রাচীন জল সংরক্ষণের চেষ্টা উঠে আসছে। এ বছর তাদের থিম, অজান্তে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জলের সঙ্কট, পানীয় জলের হাহাকার। ফুরিয়ে যাচ্ছে ভুগর্ভস্থ জল। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২০৩০ সালের পর জলশূন্যতায় ভুগবে মানুষ। তাই এবার পুজোয় জল সংরক্ষণের বার্তা দিতে গুজরাতের বিখ্যাত রানি কি ভাব জলাধার বানাচ্ছে আহিরিটোলা সার্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতি। ভাব মানে ধাপে ধাপে সিঁড়ির মতো নেমে যাওয়া যায় এমন কুয়ো। ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাতের রাজা ভীমদেবের স্ত্রী উদয়মতী এই কুয়ো তৈরি করান। রাজা ভীমদেবের স্ত্রী রানী উদয়মতী সরস্বতী নদীর ধারে এই ভাব নির্মাণ করেন। এই স্থাপত্য দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্র। আহিরিটোলা সার্বজনীনের দুর্গা প্রতিমা পূজিত হবে এই রানি কি ভাব এর ভিতরেই।

আবার, কাঁচা অবস্থায় সবজি হিসেবে এবং শুকিয়ে গেলে গা পরিস্কারের জন্য ধুধুল ব্যবহার করা হয়।

সেই ধুধুল দিয়েই সেজে উঠেছে চোর বাগান সার্বজনীনের মণ্ডপ। চোর বাগান সার্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির এ বছরের থিম, দৃষ্টি থাক সৃষ্টিতে। অন্যদিকে, শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় যানজট কলকাতার বারোমাস্যা৷ এর মধ্যে, দাপটের সঙ্গে স্টিয়ারিং ধরে নিত্যদিন কয়েকশো যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেন তিনি৷ তিনি, প্রতিমা পোদ্দার৷ 
মহানগরের একমাত্র মহিলা বাস ড্রাইভার৷ এই প্রতিমাদেবীই এ বছর নৰ্থ ত্রিধারা সার্বজনীন দুর্গোৎসবের মুখ। জীবন-যুদ্ধে লড়াইয়ের অপর নাম হতে পারে, প্রতিমা পোদ্দার৷ বিছানায় শয্যাশায়ী স্বামী৷ বাড়িতে অসুস্থ শাশুড়ি ও দুই নাবালিকা কন্যা৷ এই অবস্থায় মাথা উঁচু করে সপরিবারে বাঁচতে বাস চালক স্বামীর স্টিয়ারিংকেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন আটপৌরে বধূ৷ যে কাহিনীর কাছে রূপকথাও হার মানতে বাধ্য৷ হাওড়া-বেলঘরিয়া রুটে একটু নজর রাখলেই চোখে পড়ে মহিলা ড্রাইভার প্রতিমা পোদ্দারকে৷ বারো বছর ধরে পেশায় সফল প্রতিমাদেবী, আর তার এই সাফল্যই তুলে ধরা হচ্ছে মণ্ডপ জুড়ে। মণ্ডপের আদল মিনিবাসের মতো। মণ্ডপের দেওয়াল জুড়ে বাসের সরঞ্জাম , পুজোমণ্ডপে ঢুকতে একদম সামনেই প্রতিমা পোদ্দারের সিলিকনের মূর্তি। পুজোর পর সেই মূর্তি আবার স্থান পাবে, মাদার ওয়্যাক্স মিউজিয়ামে।

অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে কলকাতা এবং শহরতলীর প্রতিমা সজ্জাও।

টিকালো নাক, প্রশস্ত ললাট, চাপা থুতনির উপর পাতলা ঠোঁটে স্মিত হাসি, নাকের পাশ থেকে পটলচেরা চোখ।তার উপরেই মোটা ভুরু চলে গিয়েছে কপালের দুই প্রান্তে। এটাই বাংলার সাবেক দুর্গাপ্রতিমার পরিচিত মুখাবয়ব।উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ি, পাথুরিয়াঘাটা রামলোচন ঘোষের বাড়ি, হাটখোলা দত্তবাড়ি-সহ হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ির প্রতিমায় আজও দেখা যায় এই মুখ। অন্যত্র, বেশির ভাগ পুরনো বারোয়ারীপুজোয় দেখা যায় মিশ্র রীতির মুখ।দাবি, পুজো উদ্যোক্তাদের কাছে এই মুখের কদর বেশি। কুমোরটুলির প্রবীণ শিল্পীদের কথায়, সাবেক দুর্গাপ্রতিমার মুখে কিছুটা উগ্রতা এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকায় তা অনেকেই পছন্দ করেন না।


প্রতিমার সাজেও এসেছে পরিবর্তন। আগে প্রতিমার মাটির সাজের প্রচলন থাকলেও এখন তা অনেক কমে গিয়েছে। কারণ, মাটির সাজ ব্যয়বহুল।আবার বৈশাখ থেকে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় হওয়ায় কমেছে শোলার জোগান। সেই জায়গায় এসেছে থার্মোকলের সাজ।

ঐতিহ্যবাহী ডাকের সাজেও, রাংতার পরিবর্তে প্লাস্টিক পেপার। আগে নিকেল করা টিনের চুমকি ব্যবহার করা হলেও এখন বাজার দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিকের চুমকি। প্রবীণ শিল্পীদের আপসোস, প্রতিমার মুকুটেও কমেছে ময়ূরের পালক, কাচপুঁতি বুলেনের ব্যবহার।
Artisans prepare clay idols of Hindu goddess Durga at a makeshift studio in Kolkata, India, Wednesday, Sept. 25, 2019. The idols are being made for worship venues ahead of Durga Puja festival that begins first week of October. (AP Photo/Bikas Das)
The idols are being made for worship venues ahead of Durga Puja festival that begins first week of October. Source: AP Photo/Bikas Das
হারিয়ে গিয়েছে আংটির সাজ, যাতে থাকত শলমার চুমকি, বুলেন, কাচপুঁতি, নানা রঙের বসমা কাগজ।

পাথুরিয়াঘাটা রামলোচন ঘোষের বাড়ির মত আরও দু’একটি পরিবারে আজও দেখা যায় সাবেক এই সাজ। কয়েক বছরে প্রতিমার পিছনে চালিতে হাতে আঁকা পটের ব্যবহার কমেছে, বাড়ছে ছাপানো পটের রমরমা। ভাল দাম না-পাওয়ায় কৃষ্ণনগরের পটশিল্পীরা আজ আর নজরকাড়া সূক্ষ্ম পট লেখেন না। তেমনই বদলেছে চাঁদমালাও। কলকাতার পটুয়া পাড়া কুমোরটুলি তে এখন পাওয়া মুশকিল ভেলভেট কাগজের উপরে রকমারি সূক্ষ্ম কাজের শোলার সেই সব চাঁদমালা। তার জায়গা নিয়েছে কার্ডবোর্ডে ছাপা, চুমকি বসানো চাঁদমালা। আবার থার্মোকলের উপরে মেটাল চুমকি বসানো চাঁদমালা এসেছে।


প্রতি বছর পুজো আসে, তবে সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের গন্ধমাখা পুজোর কিছু কিছু উপকরণ থেকে আরও অনেক কিছু।

একটু কান পাতলেই শোনা যায়, সে সব আপসোস, নস্টালজিয়া।

 

Follow SBS Bangla on .



Share
Published 1 October 2019 2:49pm
Updated 1 October 2019 3:00pm
By Partha Mukhopadhyay
Presented by Sikder Taher Ahmad

Share this with family and friends